বাক্‌ ১১৪ ।। দৃশ্যত ।। অমিত বিশ্বাস



 রূপকল্পে যৌনতা সংক্রান্ত কয়েকটি প্রশ্ন 


'একবার কোনারকে গেছি। ওখানে ন্যুডফ্যুড সব আছে তো ... আর্ট স্কুলের ছেলেরা দেখছে। খিলখিল করছে। হাসছে। আমাদের প্রফেসর নন্দবাবু (নন্দলাল বসু) বলে দিয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের আলাদা-আলাদা দেখতে। আজকে আলাদা করবে। কালকে আলাদা করতে পারবে কি ?'
রামকিংকর বেজ

কলাভবন হোস্টেলে একটি ছেলে হস্তমৈধুন করতে গিয়ে ধরা পড়েছে, অধ্যাপকেরা দরবার করতে নন্দলাল বসুর সামনে ছেলেটিকে উপস্থিত করেছেন। নন্দলাল বসু বললেন 'আপনাদের মধ্যে কে এমন আছেন যিনি যৌবনে একবারও এই কাজটি করেন নি?'

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কোনো একদল ব্যবসায়ী গান্ধীজীকে প্রস্তাব দেন ভারতবর্ষের যতগুলি যৌনসংক্রান্ত মূর্তি আছে, সব ধংস করা হোক অথবা যৌনাঙ্গ পোশাকে ঢেকে দেওয়া হোক। গান্ধীজী নন্দলালের পরামর্শ চান।  নন্দলাল উবাচ 'এগুলিকে আপনার পিতা-মাতার রূপ হিসাবে ভাবুন'।

 সম্প্রতি এক বিজ্ঞাপনে দেখি এক পর্ণস্টার বলছে সংশ্লিষ্ট জলের বোতল আমাদের তৃষ্ণা মেটাবে ... ঠিক কি ধরণের তৃষ্ণা মেটানোর ইঙ্গিত আছে বিজ্ঞাপনে ? অথবা যৌন সুড়সুড়ি দিয়ে পণ্য বিক্রির আধুনিক প্রচেষ্টা ? যৌনাচার সংক্রান্ত এই প্রশ্নগুলি মাথার মধ্যে ঘুর ঘুর করছিল।

আদিরসকে ভারতীয় দার্শনিকগণ নবরসের তালিকায় একদম প্রথমে রেখেছেন। আমাদের জৈবিকভাবে টিকে থাকলে গেলে এর প্রয়োজন সর্বাগ্রে। কামকেলি স্বাভাবিক জীবনের একটি পর্যায়, শিল্পে তাই মিথুন রূপকল্প ফিরে ফিরে আসে কিন্তু অপর দিকে প্রলুব্ধিকরণ (temptation) শিল্পরসকে বিনষ্ট করে।  আজকের সমাজব্যবস্থায় প্রায় সবস্তরে  প্রলুব্ধিকরণের বাড়বাড়ন্ত ... অনেকটা 'গল্প হলেও সত্যি' চলচ্চিত্রে সেই বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্তার উক্তির মতন ' আমরা পাবলিককে পাগলা গারদে রেখে শক দেব ... যৌন শক ...' এই শক থেরাপির প্রাদুর্ভাব এখন চলচ্চিত্রে, কবিতায়, শিল্পকর্মে  ... লোকে বলছে বীভৎস আবার সুড়সুড় করে দেখতেও আসছে অথবা লুকিয়ে পড়ছে।  বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা, পাড়াতুতো কাকার ভাষায় বললে পশ্চাদদেশের ফুলটুকুও ঝরেনি যার সে লিখতে বা আঁকতে বসেছে যৌন প্রলুব্ধিকরণ সংক্রান্ত রচনা।  তারা সস্তা বিনোদন ও শিল্পরচনার মধ্যে পার্থক্য উপলব্ধি করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেও নারাজ।  কিছু বললেই তারা উদাহরণ দেবে আমাদের দেশে খোলাখুলি যৌনতা নিয়ে অভিমত দেবার চল প্রাচীন যুগ থেকে ... দুটি নাম বলবে, কোনারক এবং খাজুরাহো ... সাহিত্য হলে কালিদাস প্রমুখ এবং বাৎস্যায়ন। 

খাজুরাহো ।। পশ্বাচার


পড়া আছে কালিদাসের রচনাকৌশল অথবা কামসূত্রের সব অধ্যায় ... দেখা আছে কোনারকের নবরস সমৃদ্ধ ভাস্কর্য অথবা খাজুরাহো সংক্রান্ত যৌথ যৌনাচার, পশুমৈথুন অথবা স্বাভাবিক রচনাগুলি ... ???

খাজুরাহো


উত্তর নিজের মত করেই খুঁজতে হয় সবাইকে, আমিও খুঁজছি।  অসম্পূর্ণ কোনারক সূর্যমন্দিরে দেখা যায় নবরসের সবগুলি রসকেই, সেখানে নেই প্রলুব্ধিকরণ সংক্রান্ত ধান্দাবাজি। খাজুরাহোতে পশুমৈথুনের দৃশ্য আছে, একটি নারী ঘোড়াকে দুইজন পুরুষমানুষ সামনে-পিছন থেকে সম্ভোগ করছে।  একটু ঠান্ডা মাথায় নজর করলে দেখব রচনা যে দুটি পুরুষ উপস্থিত তাদের জাগ্রত লিঙ্গ খোদিত স্বত্বেও মুখভঙ্গিতে নেই কোনো প্রলুব্ধিকরণের ইঙ্গিত। পশ্চাদপটে অন্ধকারে এক নারীর উপস্থিতি বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। দেখুন নারীটি দুইহাতে মুখ ঢেকেছে ... এটি একটি যৌন-অজাচার (perversion),এই শিল্পকর্মটির উদ্দেশ্য লোকশিক্ষা কারণ শাস্ত্রকাররা অজাচারের অনুমতি দেন নি। 

খাজুরাহো


এবার ফিরি আধুনিক শিল্পকর্মে, দেখি সেখানে শিল্পীরা কিভাবে যৌনাচার বা কামকেলি সংক্রান্ত বিষয়কে কিভাবে তাদের শিল্পকর্মে ব্যবহার করেছেন। 

যোগেন চৌধুরী
 
রতিক্লান্ত দম্পতির সেই আনন্দ মিশ্রিত মুহুর্তকে যদি কোনো শিল্পী তাঁর চিত্রপটে আঁকতে চায়, সরাসরি ... কেমন লাগবে ছবিটি, আমাদের এই তৃতীয় বিশ্বের কোনো প্রদর্শনী হলে ?  অধিকাংশ দর্শক হয়তো এড়িয়ে যাবেন অথবা লুকিয়ে পর্নোগ্রাফির মজা নেবেন অথচ ঐ  আনন্দঘন মূহুর্তটির রূপকল্পটির সৃষ্টির উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে শিল্পীর। আবার সরাসরি দেখিয়ে দেবার দোষে দোষী সাব্যস্ত করবে দর্শককূল। অপরদিকে এই আনন্দঘন অনুভূতি যদি শিল্পীর একান্ত ব্যক্তিগত হয় তাহলে ... শিল্পী তো চাইবেন রূপকের আশ্রয়। আলোচিত ছবিটি শিল্পী যোগেন চৌধুরীর 'রেমিনিসেন্সেস অফ ড্রিম' বা 'স্বপ্নের স্মৃতি' সিরিজের অন্তর্গত life-1, রচনাকাল ১৯৭৩।  বিবাহোত্তর যৌনতা শিল্পীজীবন নিয়ে এসেছে ফ্রয়েডীয় অনুষঙ্গ, সঠিক করে বললে গিরীন্দ্রশেখর বসু সৃঞ্জিত অবচেতনের ফসল  ... পশ্চাদপট গাঢ়, রহস্যময় ... দৃশ্যমান বস্তু বলতে অবিন্যাস স্তূপাকৃতি মশারী এবং তার উপরে একটি পাশবালিশ। এতটুকুই কিন্তু সংকেত। রচনাকৌশনে এনেছেন ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যসুলভ অনুভূতি... পশ্চাদপট নিয়ম মেনেই অন্ধকারাচ্ছন্ন, যাতে করে সন্মুখভাগের বিষয়ে আসে ত্রিমাতৃকতা, অনুমান করে নিতে কষ্ট হয় না এটি শিল্পীর সদ্য সমাপ্ত পাশ্চাত্য ভ্রমণের ফসল। একটু নজর করলে দর্শক আবিষ্কার করবেন স্তূপাকৃতি নরম মশারীটি আসলে রতিক্লান্ত তৃপ্ত নারীদেহের রূপক। আর পাশবালিশটি পুরুষাঙ্গ অর্থাৎ সঙ্গী পুরুষটি অবস্থানগত নির্মাণ। আরো একটু খুঁটিয়ে দেখলে অনুভবে আসবে  পাশবালিশের দড়িটি আসলে সদ্য নেতিয়ে পড়া লিঙ্গ থেকে ঝরে পড়া তরল বীর্য ... যেটি সেই দম্পতির রতিক্লান্ত মুহূর্তের সময়কালকেও নিশ্চিত করছে এখানে। সরাসরি দেখালে কি এই নান্দনিক নির্মানের মজা দর্শকরা নিতে পারতেন ?  শিল্পী আসলে পুরোটা দেখিয়ে দেন না, আবার চিত্রপটকে অহেতুক দূর্বোধ্যও বানান না। তাঁর আসল উদ্দেশ্যই হল রূপকল্পের সফল নান্দনিক নির্মাণ এবং শিল্পী যোগেন চৌধুরী এই ছবিতে সেটি পূর্ণমাত্রায় গড়ে তুলেছেন।
 
 
ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত

একটি নীলাভ নগ্ন নারীদেহ চিত্রপট জুড়ে অবস্থিত, অনেকটা শোয়ার ভঙ্গিতে। লালচে গোলাপী কোঁকড়ানো কেশদামের অধিকারিণীর বাঁ হাতে একটি সবুজ সাপ জড়ানো, রঙ নির্বাচনে সাপের বিষাক্ত চরিত্রটি প্রকাশ পায়। সাপটির দ্বিখন্ডিত জিভ আর নারীটির জিভ যেন সঙ্গমে আগ্রহী। এইটুকু বর্নণা পড়ে যে কেউ বলে দেবে এটা হলিউড অথবা ফরাসী চলচ্চিত্রের কোনো বিকৃত কামদৃশ্য। এরপর যদি ছবিটির দিকে তাকাই তবে প্রথমে ধরা দেবে এক স্নিগ্ধ আবেশী পরিমন্ডল, আরো পড়ে  ধীরে ধীরে যখন ছবির গভীরে প্রবেশ করব তখন উন্মীলিত হবে এক  বাঙ্গালীয় পরাবাস্তব ... যার কল্পনা অন্তত ভারতীয় চিত্রকলায় যেন prototype।

বাঙালী জীবনের নানাদিক, বিশেষ করে স্ত্রী পুরুষের সম্পর্ক, তাদের প্রেম, সম্পর্ক, একাকীত্ব, অতৃপ্ত বাসনা, আশা-নিরাশাকে  ছুঁতে চেয়েছেন নিজের পরাবাস্তর চেতনার দ্বারা। টেম্পারায় কৃত আলোচ্য ছবিটিতে তাই নারীদেহটি অনায়াসে নীল রঙে রাঙাতে পারেন শিল্পী ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত, যে নীল রঙ আমাদের চেতনার কালী মূর্তির অনুসঙ্গ মনে করায়, বিষাক্ত সাপের চুম্বনকে অনায়াসে যে গ্রহণ করতে পারে ... এ এক মিথ ভেঙে নতুন মিথে উপনীত হবার প্রচেষ্টা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


সবশেষে যে ছবিটির কথা বলব সেটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা। আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ পূর্ণমাত্রায় ছবি আঁকা শুরু করের জীবনের অন্তিম পর্যায়ের কয়েকবছর, যদিও বিশ্বের শিল্পসম্ভারের সাথে তাঁর পরিচয় দীর্ঘদিনের।  অনামা এই ছবিটিতে কলম অথবা তুলি দিয়ে গাঢ় করে ঢাকা হয়েছে পশ্চাদপট, সামান্য আলো আছে সংযুক্ত চৌকো খোপে। সামনে দুটি ডাল জুড়ে একটি পলাশফুলের গোছা  তৈরি হয়েছে ... সেই গোছা থেকে আবার একটি ডাল উঠেছে উপরে। সেই ডালে ফুটেছে একজোড়া নীলফুল !!! স্বাভাবিক বাস্তবতা ছাড়িয়ে শিল্পী এখানে অবচেতনের টুইলাইটিং জোনে অবস্থান করেছেন।  প্রসঙ্গত জানাই পলাশফুলের আভ্যন্তরীণ গঠন অনেকটাই নারী যৌনাঙ্গের অনুরূপ। পলাশফুলের সাথে নীলরঙা কাল্পনিক ফুলের অবস্থান সৃষ্টি করেছে এক অবরুদ্ধ যৌনতা।  রবীন্দ্রনাথকে আমরা ঋষিতুল্য ব্যক্তি মনে করি, তাই অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন না। তারা মনে করেন বিপত্নীক ঠাকুরের কোন যৌনচেতনা থাকতে পারে না, যা থাকে তা হল এক ব্যক্তির খাঁটি সন্তরূপ।  অথচ দেখুন বাস্তব আর পরাবাস্তবের মেলবন্ধনে রবীন্দ্রনাথ কী সুন্দরভাবে তাঁর অবরুদ্ধ যৌন অনুভূতিকে শিল্পে পরিণত করেছেন। খুবই মার্জিত এবং পরিচ্ছন্ন দৃষ্টান্তমূলক কাজ।

প্রবন্ধের শুরুতেই রামকিংকরের প্রশ্ন ছিল কেন নন্দলাল বসু কোনারক ভ্রমণে  ছেলে ও মেয়েদের আলাদা ভাবে দেখাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। যে বয়সকালে শিল্পশিক্ষার্থীকে কোনারক জাতীয়  শিক্ষামূলক ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া হয় সেইসময় তাদের শিল্পবোধ অতটা মার্জিত এবং সংযত থাকে না এটি শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু জানতেন, তাই এই ব্যবস্থা।  বিশ্বায়নের যৌন-শকথেরাপীর যুগে সস্তা প্রলুব্ধিকরণ সংক্রান্ত ধান্দাবাজি থেকে বিরত থেকে সঠিক সংযত শিল্পনির্মাণের প্রয়োজনে ঠিক কি করা উচিত তা গভীরভাবে ভেবে নিয়ে নিজের পদক্ষেপ ফেলা একান্তই জরুরী।  শিল্প অথবা সাহিত্য রচনা আগে একবার তো চিন্তা করবেনই কাদের জন্য লিখছেন অথবা রচনা করছেন ... কখনো এমনটা তো মনে  হয় না যে  আপনার কষ্টার্জিত রচনাটি  লোকে পর্নোগ্রাফি রচনা হিসাবেই নিচ্ছে আর আপনার শ্রম ও দর্শন এবং রূপকল্পটির সৃষ্টির উদ্দেশ্য বিফলে যাচ্ছে ... একবার তো ভাবা যেতেই পারে।

অমিত বিশ্বাস
কৃষ্ণনগর
১৫/০৯/২০১৭

৭টি মন্তব্য: