অযোধ্যা
পাহাড় থেকে মেঘে মেঘে কার চিঠি বৃষ্টির অক্ষরে
বাবাকে নিয়ে
ধারাবাহিক লিখতে বলেছে অনুপম। বাকের প্রতি সংখ্যায় থাকবে। কাজটা সহজ নয়। আবার জটিলও নয়।
সহজ হত যদি বাবা পাতার পর
পাতা লিখে রাখতেন নিজের জীবনের কথা। তাহলে অনেক তথ্যই পেয়ে যেতাম
সেখান থেকে। ডায়েরি লেখার অভ্যাস বাবার কোন কালেই ছিলনা। ডায়েরি বলতে
আত্মজীবনী মূলক কথা। নিজের কথা। কবিসঙ্গের কথা । কবিতা লেখার ক্ষেত্রেও এই এক অভ্যাস। কখনও কবিতার কপি রেখে কাওকে লেখা দিতে দেখিনি বাবাকে। লিখতে লিখতে
লেখা শেষ হলে সেই কবিতাটি পত্রিকায় পাঠিয়ে দিতেন। তখনকার ডাকব্যবস্থা এখনকার মতো
ছিলনা। বেশিরভাগ চিঠিই পৌঁছে যেত সম্পাদকের দপ্তরে। তবু অনেক কবিতা যে মাঝপথে হারিয়ে যায়নি একথা হলফ
করে বলা যাবেনা। এমনিতেই বাবার গ্রন্থিত কবিতার চেয়ে অগ্রন্থিত কবিতার সংখ্যা
অনেকগুন বেশি। যা রয়ে গেছে লিটল ম্যাগাজিনের পাতায়। তার উপর
এইসব মাঝপথে হারিয়ে যাওয়া কবিতার সংখ্যা ধরলে আরও বিস্তৃত হবে গণিত। অগ্রন্থিত সেই সব কবিতার নির্বাচিত কিছু অংশ নিয়ে শীঘ্রই
প্রকাশিত হবে ‘অযোধ্যা পাহাড়ে চাঁদ”। ছোটদের
জন্য কবিতা, অনুবাদ কবিতা, লোকসংস্কৃতি মূলক প্রবন্ধ নিয়েও ভাবতে হবে পরে।
যে কথা
বলছিলাম। ডায়েরি লেখার অভ্যাস। ডায়েরির পাতা খুঁজতে গেলে কবি লেখক পত্রিকার ঠিকানা পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে কবে কোথায় কোন সমাবেশ
সভা সমিতি । অনেকের ডায়েরিতে যেরকম সাংসারিক হিসেব নিকেশ লেখা থাকে। তাও দেখিনি।
কোন সম্পাদকের অনুরোধে 'ছেঁড়া ক্যানভাস’
নামে আত্মজীবনীর কিছু অংশ লেখবার চেষ্টা করছিলেন । তা তিন পাতার বেশি এগোয় নি। বাবাকে
এ নিয়ে অনুযোগ জানিয়েছিলাম – সবাই কত আত্মজীবনী লিখে রাখে। আত্মজীবনী মূলক
গদ্যগ্রন্থ। তুমি তো সেসব লিখলে না। বাবা হাসত তখন। এখনও অস্পষ্ট কথার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে সেই
অবিকল হাসির ফোয়ারা – কি হয় ওসব লিখে? একজন কবি কি তার আত্মজীবনীর ভেতর থাকে
নাকি কবিতায় ? যারা কবিকে খুঁজতে চাইবে
তারা কবিতার ভেতরই তো পেয়ে যাবে সবকিছু। আসলে গুছিয়ে রাখার অভ্যাস তো ছিলনা কখনই।
অনেকে যেমন বিভিন্ন মুহুর্তের ছবি রাখে সুখস্মৃতি হিসেবে। সেসব বাবার ধাতে নেই।
আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকের কাছ থেকে সেই সব স্মৃতির সামান্য কিছু অংশ সংগ্রহ করেছি।
অনেকে নিজে থেকেও দিয়েছেন। তবে কয়েকটি বিষয়ে বাবার যত্নের ত্রুটি দেখিনি । পত্রিকা
গুছিয়ে রাখার ব্যাপারে তাঁর শৃঙ্খলা অবশ্যই শিক্ষণীয়। অসুস্থ হওয়ার আগে অবধি বাবার বৈঠকখানা থেকে কেউ কোন পত্রিকা নিয়ে গেলে
বা বিন্যাসের পরিবর্তন ঘটালে অগণিত পত্রিকা বইপত্রের ভিড়েও বাবা বুঝে
যেতেন ওই নির্দিষ্ট পত্রিকাটি নেই। যার ভেতর কোন কবিতা আছে তাও নাম উল্লেখ করে বলে দিতেন। বুঝতাম
বাইরের লাইব্রেরির পাশাপাশি বাবার মাথার ভেতরও একটা লাইব্রেরি আছে। নতুন যারা লিখছে সেই সব তরুণ কবিদের প্রথম চিঠি
বাবা বেশ যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছেন ফাইলে। তাদের অনেকেই আজ হয়তো কবিতার মানচিত্রে নেই ।
তবু মাঝে মাঝে সেই চিঠির ভেতর আমি তাদের কবিমুখ খুঁজে পাই।
পুরুলিয়ার
এক প্রত্যন্ত গ্রাম শিয়ালডাঙ্গা। ১৯৩৭ সালে
যে সময় বাবার জন্ম তখন তা ছিল
অবিভক্ত মানভূম জেলায়। বিহারের মধ্যে। কবিতা লেখার মানুষ তো দূরের কথা কবিতা নিয়ে
চর্চা করার লোকজনও ছিলনা গ্রামে। সংস্কৃতি বলতে গ্রামীণ যাত্রাপালাই বুঝত মানুষ।
খরাপ্রবণ মানভূমের গ্রামচিত্রে টুসু, ঝুমুর কীর্তনের সুর ছিল ।লোকগান ছিল। আর ছিল চৈতন্যমঙ্গলের
মনসামঙ্গলের জাঁত। কবিতার শব্দপথ সেভাবে তৈরি ছিল না। নিজের মতো করে কেউ কেউ লিখছেন। কিন্তু জেলার বাইরে
তাঁদের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কবিতায়
পুরোপুরি খরাক্লিষ্ট। সারা জেলায় কবিতার
কোন পত্রিকাও প্রকাশিত হত না। মুক্তি,
সংগঠন প্রভৃতি সংবাদপত্রে সামান্যতম অংশ জুড়ে দু একটা কবিতা কালেভদ্রে ছাপা হত। আমার দাদু রাখহরি গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন শিক্ষক।
জেলার খবরাখবর রাখার জন্য এই দুটো খবরের কাগজ তিনি নিয়মিত নিতেন। এছাড়া সেই সময়
ছোটদের উল্লেখযোগ্য পত্রিকা বলতে রামধনু শিশুসাথী মৌচাক প্রভৃতির তিনি ছিলেন
নিয়মিত গ্রাহক। বাবার কবিতার সাথে সংযোগের সূত্র যদি ধরা যায় তাহলে এটুকুই। এইসব পত্রিকায় কবিতা আর ছড়া পড়তে
পড়তেই কবিতার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসা। অন্তত
চিন্তা চেতনা আর ভাবনার একটা রাস্তা তৈরিতে সাহায্য করেছিল এই পরিবেশ।
তারপর মেঘ
জমতে শুরু করল অযোধ্যা পাহাড়ে। হ্যাঁ ,
কবিতার মেঘ তৈরি হতে শুরু করল খাতায়, সাদা দেওয়ালে, মনে। সেখানে বিদ্যুতের ঝিলিক ,
ঝড়ের প্রহর আর তীব্র দাবদাহ। খাতার পাতা
থেকে সেই সেই মগ্নগম্ভীর শব্দগুলি একদিন দাবি করল বৃষ্টিপাত – আমরা
কতদিন এভাবে লুকিয়ে থাকব পাহাড়ের কোলে?
তোমরা কি
আত্মপ্রকাশের কথা বলছ?
হ্যাঁ।
কিন্তু
সেসময় তো এখনও হয়নি। এই তো সবে শুরু , কাঁচা লেখা , এসব কি কোন কবিতা? যা যখন মনে এসেছে লিখেছি।
এই জায়গাটা
কী সুন্দর লিখেছো পড়ে দেখ “চাইনা মোরা
চাইনা ওরে এমন স্বাধীনতা’।
বলছো ?
কিন্তু কবিতা ছাপা হলে তো সবাই জেনে যাবে। বাবা, দাদা, মা। বলবে পড়াশোনা না করে
এইসব।
তবু লুকিয়ে
রাখা কবিতার খাতা থেকে দুটি কবিতা একদিন চুপি চুপি পাঠাল সেদিনের কিশোরটি । সংগঠন পত্রিকার ঠিকানা লিখতে গিয়ে তার
হাত কাঁপছিল। গলা শুকিয়ে আসছিল। স্বামী অসীমানন্দ সরস্বতীর নাম শুনেছে কিন্তু দেখা হয়নি
মানুষটিকে। একসময় বিপ্লবী ছিলেন তিনি। মানভুম কেশরী অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তী। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু যতবার মানভুমে এসেছেন তাঁর কাছেই উঠেছেন,
থেকেছেন রামচন্দ্রপুরে তাঁর আবাসনে। নেতাজীর একেবারে ঘনিষ্ট অনুরাগী এবং সহযোদ্ধা তিনি।
অযোধ্যা পাহাড়ের চেয়েও দীর্ঘ এবং বিশাল
ব্যক্তিত্বের এই মানুষটি নিজেও একজন কবি। তাঁর
কাছে এই আবেগমাখা সদ্য কিশোরের লেখা কি গৃহীত হবে? ভয় আশঙ্কা এবং এক
অদ্ভুত আবেশ মিলেমিশে একাকার।
কয়েকদিন
পর একটি চিঠি এল পত্রিকার দপ্তর থেকে। ভাগ্যিস কেউ দেখতে পায়নি সেই পোস্টকার্ড। মনের আনন্দে প্রেমপত্রের মতো বারবার ভেসে উঠল সেই অক্ষরমালা
– “খুব ভালো লেগেছে তোমার কবিতা। নিয়মিত কবিতা পাঠিও এরকম।” ঢেউ নেমে আসছে আনন্দে। বৃষ্টির অক্ষরগুলি তাকে ভাসিয়ে দিচ্ছে তুমুল উত্তেজনায়। শুকনো ডাংরা
নদী ভেসে যাচ্ছে জলে ও প্লাবনে। (ক্রমশ )
গুরুত্বপূর্ণ লেখা। ভালো লাগছে। প্রতি সংখ্যায় অপেক্ষা থাকবে।
উত্তরমুছুনপরের টার জন্য অদম্য কৌতুহল থাকলো ।
উত্তরমুছুনখুব ভালো সূচনা, বিপ্লব'দা। মোহিনী কাকুর লেখালেখি বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল। এবার তার কিছু পেতে শুরু। এই লেখাটি ধারাবাহিক চলুক, আমাদের পিপাসা মিটবে কিছুটা হলেও।
উত্তরমুছুনওঁর সময়ে এবং ওঁর জায়গায় কবিতার চর্চা রীতিমত একটা লড়াই ছিল । এখন সেটা বুঝে ওঠা বেশ কঠিন ।
উত্তরমুছুনমুখিয়ে রইলাম।আরও জানবার জন্য।
উত্তরমুছুন