বাক্‌ ১১৪।। প্রদোষ পাল ।। একটি প্রেমের গল্প



বেনিগনোর মধ্যে একটু মেয়েলি স্বভাব রয়েছে। মা মারা যাওয়ার পর মায়েরই নার্সিং পেশাকে সেও জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছেহয়তো ওর মধ্যে কিছুটা মেয়েলি স্বভাব তাই মেয়েদের নার্সিং-এর ব্যাপারে ডাক্তারাও ওর ওপর পুরোপুরি নিশ্চিন্ত। বয়স ২৮/৩০

স্পেনের মাদ্রিদ শহরের যেখানে তার ফ্ল্যাট, দোতালার ব্যালকনি থেকে গ্রাউন্ডফ্লোরে দেখা যায় একটা নাচের স্কুল। সেখানে নাচ শিখতে আসে ছিপিছিপে সোনালি চুলের গভীর নীল চোখের ২২ বছরের একটি
মেয়ে, আলিসিয়াবেনিগনো আলিসিয়ার প্রেমে পড়ে গেল। রোজ ব্যালকনি থেকে সে লক্ষ্য করে নাচের ক্লাস শেষ করে কেমন করে ধীরে পায়ে বাড়ির পথে আলিসিয়া হেঁটে যায়। আলিসিয়া অবশ্য কোনোদিন খেয়ালই করেনি তাকে কেউ লক্ষ্য রাখছে কিনাবেনিগনো শুধু ভাবে, কী করে ওর সঙ্গে আলাপ করা যায়? একদিন সুযোগ এল। ব্যালকনি থেকে দেখল একটা কাগজ বের করতে গিয়ে আলিসিয়ার পার্স ফুটপাথে। সে খেয়াল করেনিবেনিগনো পড়ি মরি নীচে নেমে এসে ছুটতে ছুটতে ফুটপাথ থেকে পার্সটা তুলল। আরো ছুটে আলিসিয়ার পাশে। তবে কিছু বলতে পারলো না। বেশ কিছুক্ষন আলিসিয়ার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। বেনিগনোকে পাশাপাশি হাঁটতে দেখে আলিসিয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'কী ব্যাপার, আপনি আমাকে এভাবে ফলো করছেন কেন?'
'না তা নয়, আসলে আপনার পার্সটা রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল'
বেনিগনোর হাতে পার্স দেখে আলিসিয়ার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
'
তাই? অনেক ধন্যবাদ আপনাকে'


স্বাভাবিক ভাবেই আলিসিয়াকে ভদ্রতার খাতিরেই বেনিগনোর সঙ্গে কিছু কথা বলতে হচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতেই চলছিল কথা। আলিসিয়া পুরোনো দিনের সিনেমা দেখতে খুব পছন্দ করে। বিশেষত নির্বাক যুগের। বেশ অবাক হলো বেনিগনো। আজকালকার দিনে এমন রুচি সচরাচর দেখা যায়না। সে যেন আরো ভালোবেসে ফেলল

একসময় দুজনের হাঁটা শেষ। বেনিগনো লক্ষ্য করলো আলিসিয়া যে বাড়ির গেটে ঢুকলো সেটি মাদ্রিদ শহরের অন্যতম মনস্তাত্ত্বিক ডাক্তার রমকেরোর চেম্বার কাম বাড়ি। তাহলে আলিসিয়া কি ডাক্তার রণকেরোর কন্যা? 
আলিসিয়াকে আর একবার কাছ থেকে দেখার লোভে বেনিগিনো ডাক্তার রণকেরোর একটা এপয়েন্টমেন্ট নিল। সেই মতো একদিন হাজির চেম্বারে। বেনিগনোর চোখ এদিক ওদিক ঘুরছে, যদি আলিসিয়াকে একবার দেখা যায়! কিন্তু কোথায় সে?

'
বলুন আপনার কী হয়েছে?'
ডাক্তারের গম্ভীর প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে কি উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পারলো না বেনিগনো। শুধু বলল আমি মানসিক অবসাদে ভুগছি।
'
ঘুম হয়?', 'কোনো মেয়ে বা ছেলের সঙ্গে সেক্স হয়েছে?'

ডাক্তারের ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্নের মোটামুটি উত্তর দিয়ে সে যাত্রায় রেহাই পেল বেনিগনো। চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসার আগের মুহূর্তে পাশে আধভেজানো দরজা দিয়ে একবার ভেতরে উঁকি মারল বেনিগনো। বাথরুমের কাচের দেওয়ালে এক নারী মূর্তির ছায়া। আলিসিয়া? পায়ে পায়ে আলিসিয়ার বেডরুমে ঢুকে পড়ল। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা আলিসিয়ার প্লাস্টিকের একটা হেয়ার ক্লিপ টুক করে পকেটে চালান করে বেরিয়ে পড়লো। বেরোনোর মুহূর্তেই বাথরুম থেকে তোয়ালে জড়ানো আলিসিয়ার মুখোমুখি।
আলিসিয়া চিৎকার করে উঠল, 'সেকি, আপনি এখানে কী করছেন?'
বেনিগনো একটু থতমত খেলেও সামলে বলল, 'আমি জাস্ট তোমাকে দেখতে এসেছিলাম, আমি একটুও হার্মফুল নয়, আমার দ্বারা তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।'
কথাগুলো বলতে বলতে বেনিগনো বেরিয়ে গেলো। আলিসিয়ার মুখদিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছিল না। বিস্ময়ে শুধু তাকিয়েই থাকল।
পরেরদিন ছিল বৃষ্টিমূখর। বৃষ্টির ছাঁটের মধ্যেই ব্যালকনি থেকে বেনিগনোর চোখ গ্রাউন্ডফ্লোরে নাচের স্কুলের দিকে। যদি আলিসিয়াকে একবার দেখা যায়! না! কোথাও আলিসয়াকে দেখতে পেল নাওপর থেকে দেখলো কেউ একজন নাচের দিদিমণিকে কিছু একটা এসে বলল। দিদিমণির মুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ স্পষ্ট। একজনকে স্কুলের চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে হন্ত দন্ত হয়ে ছাতা মাথায় কোথায় যেন বেরিয়ে গেলেন দিদিমণি! বেনিগনোর কপালে ভাঁজ। তাহলে কী আলিসিয়ার কিছু হয়েছে? আনমনা হয়ে বেনিগনো কখন যেন রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। কখন যেন সে আলিসিয়াদের বাড়ির গেটে
হ্যাঁ! আলিসিয়া গভীর গাড়ি এক্সিডেন্টে কোমাচ্ছন্ন। বেনিগনো যেদিন ওর বাবার চেম্বারে গিয়েছিল, যেদিন সে আলিসিয়ার বেডরুম থেকে ওর হেয়ার ক্লিপ চুরি করে নিয়ে এসেছিল, যেদিন আলিসিয়া বাথরুম থেকে বেরিয়ে আচমকা বেনিগনোকে দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল, সেদিনই বৃষ্টি বাদলার রাতে আলিসিয়া গাড়ি এক্সিডেন্ট করে। সে এখন সম্পূর্ণ কোমায়।


বেনিগনোর ভাগ্য যেমন খারাপ আবার একদিকে ভালো বলতে হবে। আলিসিয়াকে যে হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়েছে সেখানে তার বাবা আলিসিয়ার জন্য প্রাইভেট ফিজিও প্লাস নার্সিং-এর যাবতীয় দায়িত্ব বেনিগনোকে দিয়েছেন। হয়তো তার মেয়েলি স্বভাব কাজটা পেতে সাহায্য করেছেআলিসিয়ার ডাক্তার বাবা বেনিগনো দেখে বুঝেছিল আর যাই হোক ছেলেটির মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ নেই।
গত চার বছর বেনিগনোর জীবনে শুধুই আলিসিয়া। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বেনিগনোর একটাই কাজ আলিসিয়ার সেবা করা। আলিসিয়া সম্পূর্ণ কোমায় আচ্ছন্ন, চোখ মেলে তাকায় না। বিন্দুমাত্র তার শারিরীক, মানসিক অনুভুতির প্রকাশ নেই। বেনিগনো তবুও কিন্তু অনবরত আলিসিয়ার সঙ্গে কথা বলে চলে। ঈশ্বরকে তার যেন অনেক ধন্যবাদ সে আলিসিয়ার জন্য জীবন উৎসর্গ করে সেবা করে যেতে পারছে। বেনিগনো কোনো সিনেমা, নাটক বা নাচের অনুষ্ঠান দেখে এলে আলিসিয়াকে সব গল্প বলে শোনায়। একদিন এসে বলল, 'আজ পিনা বাউসের নাচের অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলাম, আমার পাশে বসে একজন নাচ দেখছিলেন, জানো সে শুধু কেঁদেই যাচ্ছিলেন'!

আলিসিয়ার বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া নেই, বেনিগনো কিন্তু বক বক করেই চলে। রাতে নাইট ডিউটির জন্য অন্য একটি মেয়ে আসে। তাকে সব বুঝিয়ে সে বাড়ি যায়।

বেনিগনোর জীবনে কোনো দুঃখ নেই। সারাদিন আলিসিয়ার সেবা করেই তার যেন যত আনন্দ। মাঝে মাঝে আলিসিয়ার পছন্দের নির্বাক যুগের সিনেমা দেখতে যায়, আর দেখে এসে আলিসিয়াকে গল্প বলে শোনায়। 


‌একদিন সেই হাসপাতালে আরও একজন মহিলা কোমাচ্ছন্ন ভর্তি হলোমার্দিদ শহরের নামকরা বুল ফাইটার লিডা গঞ্জালেজ।। ষাঁড়ের গুঁতোয় ক্ষতবিক্ষতকোমাচ্ছন্ন হয়ে ভর্তি হয়েছে। লিডার তো বেনিগনো নেই যে দিন রাত সেবা করবে আর গল্প করে শোনাবে? লিডার বয়স প্রায় ৩৫ বছর। কিছুদিন আগে তারও অবশ্য একজন বয়ফ্রেন্ড হয়েছে। পেশায় সাংবাদিক। নাম মার্কো জুলুয়াগা। ঘটনাচক্রে লিডার সঙ্গে বন্ধুত্ব। একদিন মার্কো নিজের ঘরে টিভিতে লিডার ইন্টারভিউ দেখছিল। মাথায় এলো, নামকরা বুলফাইটার লিডা গঞ্জালেজের একটা ইন্টারভিউ তাদের সংবাদপত্রে ছাপলে কেমন হয়? সেই মতো সম্পাদকের অনুমতি আদায় করে লিডার সঙ্গে দ্যাখা করতে গেলো মার্কো। লিডা জানাল, একটু পরে সে বাড়ি ফিরবে, যেতে যেতে কথা বলতে পারে। মার্কো ড্রাইভ করে লিডাকে বাড়ি পৌঁছোতে গেল। পথে যেতে যেতে দুজনের কথাবার্তা চলছিল। কথা বলতে বলতে লিডা বুঝল মার্কোর স্পোর্টস, বিশেষ করে বুলফাইটং সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। লিডা রেগে বলল, 'আপনার বুলফাইটিং সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নেই যখন কেন আমার ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন?' লিডা তার বাড়ির একটু আগেই রেগে মেগে গাড়ি থেকে নেমে গেল। মার্কো ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গাড়িতে বসে। দেখল লিডা নিজের বাড়ির চাবি খুলে রেগে দ্রুত ঢুকে গেল। গাড়ি ঘুরিয়ে একটু এগোতেই কানে এলো লিডার আর্তনাদ। প্রাণপনে লিডা চিৎকার  করতে করতে তার গাড়ির দিকেই ছুটে আসছে। জানতে পারলো লিডার রান্নাঘরে বিশাল একটা সাপ। মার্কো গাড়ি থেকে নেমে একাই লিডার বাড়িতে গিয়ে সাপটাকে মারল। 


লিডা বলল সে আজ আর এই বাড়িতে থাকতে চায়না, তাকে যেন কোনো হোটেলে সে নিয়ে যায়। মার্কো সেই মতো লিডাকে একটা হোটেলে নিয়ে গেল। আস্তে আস্তে লিডার রাগও পড়তে শুরু করলো। ধীরে ধীরে গাঢ় হতে থাকলো বন্ধুত্ব। লিডা বুঝতে পারলো মার্কো খুব ভালো মানুষ। খুব সেনসিটিভ মনের। একদিন লিডা আর মার্কো একজনের আমন্ত্রনে ঘরোয়া এক অনুষ্ঠানে গান শুনতে গিয়েছিল। লিডা লক্ষ্য করলো, গান শোনার সময় মার্কোর দুচোখ বেয়ে অবিরল অশ্রুধারা নেমে আসছে। লিডা অবাক হয়ে গেল। মার্কো চোখের জল মুছে বাইরে বাগানে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। লিডা চুপিচুপি এসে মার্কোকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনে ভরিয়ে দিল। গাঢ় হলো দুজনের বন্ধুত্ব। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ভাগ্য বিরূপ। কয়েকদিনের মধ্যেই ভয়াবহ ষাঁড়ের লড়াইয়ে লিডা ক্ষতবিক্ষত ও কোমায় আচ্ছন্ন। মার্কো হাসপাতালে সারাদিন চুপ করে শুধু বসে থাকে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলো হয়তো কোনোদিনও আর লিডার জ্ঞান ফিরবে না। লিডার প্রাক্তন প্রেমিক যে লিডাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, মাঝে মধ্যে এসে লিডার হাত জড়িয়ে ধরে বসে থাকে, কিন্তু তেমন কোনো গভীর ভালোবাসার অভিব্যক্তি মার্কোর চোখে পড়ে না। এই হাসপাতালেই একদিন বেনিগনোর সঙ্গে মার্কোর আলাপ হলো। বেনিগনো একদিন লিডাকে এসে দেখেও গেল। 


বেনিগনোর দাওয়াই, এই ধরণের রোগীর সঙ্গে অনবরত কথা বলে যেতে হয়। তাতে নাকি ভেতরের নার্ভ সচল হয়। মার্কো জানতে চাইলো বেনিগনো কোথা থেকে এটা জেনেছে? বেনিগনো বলল, চার বছর ধরে আলিসিয়ার সেবা করতে করতে এটা সে শিখেছে। এ ধরণের রোগীর সঙ্গে অনবরত কথা বলে যেতে হবে। স্বাভাবিক জ্ঞান না থাকলেও নার্ভের ভেতর নাকি অনুভূতি কাজ করে। দুজন একই রকম প্রেমিকের বন্ধুত্ব দৃঢ় হচ্ছিল। বেনিগনো তার জীবনের সব কথা মার্কোকে জানায়।

একদিন মার্কোকে মাদ্রিদ শহর ছেড়ে রিপোর্টিং করতে অন্য শহরে চলে যেতে হলো। সেখানেই  সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পারলো লিডা গঞ্জালেজ মারা গিয়েছে। বেনিগনোর কথা মার্কোর মনে পড়লো। কেমন আছে সে? কেমন আছে আলিসিয়া? মার্কো হাসপাতালে ফোন করে জানতে পারলো, বেনিগনো এখন জেল খাটছে। আলিসিয়া প্রেগন্যান্ট হয়েছিল। তাকে রেপ করার চার্জে বেনিগনোকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মার্কো হতবাক! বেনিগনোকে খুব কাছ থেকে সে দেখেছে। এতো ভালো ছেলে, ওর ভালোবাসার তুলনা হয়না। বেনিগনো কোমাচ্ছন্ন আলিসিয়াকেই বিয়ে করবে মনস্থির করে ফেলেছিল। কিছুতেই এ কাজ সে করতে পারে না। ছুটল জেলখানায় বেনিগনোর সঙ্গে দেখা করতে। 


মূল শহর থেকে বহু দূরে প্রায় নো ম্যানস ল্যান্ডে জেলখানাটি অবস্থিত। বাইরের একচুলও খবর সেখানে গিয়ে পৌঁছয় না। মার্কো যেতেই বেনিগনোর একটাই জিজ্ঞাস্য কেমন আছে আলিসিয়া? যে ভাবেই হোক আলিসিয়ার খোঁজ চাই। তার পেটের বাচ্চাটারই বা কী খবর? সে কী বেঁচে আছে? বেনিগনো বলল, অন্য কোনো বড় ল-ইয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। আইনি খরচের জন্য সে তার ফ্ল্যাট ভাড়া দেবে। মার্কো শুনে বলল, আপাতত এ শহরে তার কোনো বাসা নেই, বেনিগনোর বাড়িটা তবে সেই ভাড়া নিতে পারে। বেনিগনো শুনে খুবই খুশি হলো। এর থেকে ভালো আর কী হতে পারে! ল্যান্ড লেডির কাছে ফ্ল্যাটের চাবি রয়েছে। সেই মতোই মার্কো চাবি নিয়ে বেনিগনোর ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করলো। 

যে ব্যালকনি থেকে বেনিগনো নীচে নাচের স্কুলে আলিসিয়াকে দেখতো, মার্কোও একদিন দাঁড়িয়ে নাচের স্কুলের দিকে লক্ষ্য রাখলো। একদিন নাচের স্কুলে বসে থাকা একটি মেয়ের দিকে চোখ যেতেই বিস্ময়ে হতবাক। আলিসিয়া! চুপ করে একটা চেয়ারে সে বসে। তার চোখ খোলা, সবই দেখছে, কিন্তু সে চোখ অনুভূতিহীন। মানে আলিসিয়া এখনও কোমাচ্ছন্ন!


 বেনিগনোর পূর্বতন ল-ইয়ারের সঙ্গে দেখা করে মার্কো জানতে পারলো আলিসিয়ার একটি মৃত বাচ্চা হয়েছে একমাস আগে। সে আগের মতোই কোমাচ্ছন্ন। এসব কথা মার্কো যেন কোনো ভাবে বেনিগনোকে এখনই না জানায়, সে নিজেই সময়মতো সব বলবে। এও জানালেন এই কেসে বেনিগনোর জামিন পাওয়া খুবই কঠিন।

মার্কো জেলে গিয়ে বেনিগনোর সঙ্গে দেখা করলো, কিন্তু ল-ইয়ারের কথা মতো আলসিয়ার বর্তমান অবস্থা বেনিগনোকে জানালো না। বেনিগনো জানালো সে নতুন ল-ইয়ারের সঙ্গে কথা বলছে কিন্তু আশার আলো দেখতে পাচ্ছে না।

একদিন ভোরে মার্কো মোবাইল অন করতেই ভেসে উঠল ভয়েস ম্যাসেজের বার্তা। মোবাইলে কানে লাগাতেই মার্কো শুনতে পেল বেনিগনোর ভয়েস ম্যাসেজ, "I was very happy to see you and say goodbye. They won't to let me get out of here, or they put me somewhere else. I don't want to live without Alicia. Without being able to hold not one pin for hers. Therefore I will escape. I didn't tell you so that you won't stop me. I hug you firmly, Marco."

মার্কোর বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল! বুঝতে বাকি রইলো না কী বিপদ ঘটতে চলেছে বা ঘটে গিয়েছে ইতিমধ্যে! পড়িমরি নেমে এসে একটা ট্যাক্সি ধরে ছুটলো জেলখানায়। উর্দ্ধশ্বাসে রিসেপশনে গিয়ে বেনিগনোর কথা জানাল। রিসেপশন থেকে জানানো হলো জেলার মহাশয় ওর জন্য অপেক্ষা করছেন। জেলার মার্কোর হাতে একটা চিঠি দিলেন।

‌ "
প্রিয় মার্কো, আজ এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। এটা খুব ভালো লক্ষন। আলিসিয়ার যেদিন এক্সিডেন্ট হয় সেদিনও বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি চলে যাওয়ার কয়েক মিনিট আগে তোমাকে লিখছি। আশাকরি আমিও কিছুক্ষনের মধ্যে কোমায় চলে গিয়ে আলিসিয়ার পাশে জায়গা নেবো। তুমিই আমার একমাত্র বন্ধু, আমি তোমাকেই আমার ফ্ল্যাটটা দিয়ে যাচ্ছি। ওটা গুছিয়ে রেখেছিলাম আমাদের দুজনের জন্য। এরা আমাকে যেখানে কবর দেবে সেখানে আমার সঙ্গে দ্যাখা কোরো। আমাকে সব কিছু বোলো। কোনো কিছু গোপন কোরো না।
বিদায় বন্ধু।"

জেল থেকে একে একে বেনিগনোর জিনিসগুলো মার্কোকে ফেরৎ দেওয়া হলো। মার্কো দেখলো একটি খামের মধ্যে আলিসিয়ার বাড়ি থেকে চুরি করা সেই হেয়ার ক্লিপটাও রয়েছে। মার্কো পারলো না নিজেকে সংযত করতে। জেলারের সামনেই ডুকরে কেঁদে উঠল।

বেনিগনোর কবরের সামনে মার্কো সব কথা জানালো, যা বেনিগনোকে এতদিন জানায়নি, বিশেষ করে আলিসিয়ার কথা বিড় বিড় করে বলে গেলো। এও জানালো, কবরের প্যাকেটে আলিসিয়ার হেয়ার ক্লিপ, আলিসিয়া ও বেনিগনোর মায়ের একটা ফটো রেখে দিয়েছে। ওগুলো তার সঙ্গে চিরদিন থেকে যাবে।

বেশ কিছুদিন পর একদিন এক নাচের অনুষ্ঠানে মার্কো আবার আলিসিয়াকে দেখতে পেল। তার চোখ তেমনই অর্থহীন। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে শুধু। মার্কোর বুক যেন ফেটে যাচ্ছে। কী সরল এ চাহনি। কিছুই জানেনা বেচারা সরল মেয়েটা। চার বছর একটি ছেলে দিনরাত সেবা করে কিছুটা সুস্থ করে তাকে এ অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে। জেলে গিয়ে সে জীবন শেষ করে দিল। তার বিন্দুমাত্র আঁচ জীবনে কোনোদিন আর পাবে না ও! কোনোদিন জানবেও না এ শতাব্দীতে বেনিগনোর মতো কেউ তাকে ভালোবাসতে পারে!

মঞ্চ অন্ধকার হলো।
শুরু হবে নাচের অনুষ্ঠান।

গল্প শেষ।
স্পেনের অন্যতম বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক পেদ্রো আলমাডোভারের পরিচালনায় ২০০২ সালের একটি ছবি 'টক টু হার' এর কাহিনি গল্প করে বললাম। এ ছবির ক্রিটিক্যাল আলোচনা বোধহয় কিছুই করার নেই। কাহিনিই সব বলে দিয়েছে। আলমাডোভারের অনেক ছবি দেখেছি। তিনি স্পেনের একজন বিতর্কিত পরিচালকও বটে। তবুও এ ছবি সব দিক থেকেই যেন আলাদা। বর্তিমান সময়ে একটি প্রেমকে যে এতো আধুনিক করে উপস্থাপনা করা যায় তা ছবিটি না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

সংগ্রহ করে দেখার চেষ্টা করুন। এক অনন্য অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকবেন।

৬টি মন্তব্য:

  1. ২০০৫ তে দেখেছিলুম। ভালো লাগল। কিন্তু আপনি সেই আখ্যানেই জোর দিচ্ছেন। আল্মাদভারের ভিসুয়ালস নিয়ে আলোচনা করলে ভালো লাগবে।

    উত্তরমুছুন
  2. দেওয়া-নেওয়া জগতের বাইরে এক অন্য ভালোবাসার পৃথিবীর গল্প..ভালো লাগল

    উত্তরমুছুন
  3. দেওয়া-নেওয়া জগতের বাইরে এক অন্য ভালোবাসার পৃথিবীর গল্প..ভালো লাগল

    উত্তরমুছুন
  4. খুব ভালো লাগলো এ এক নিঃস্বার্থ প্রেমের গল্প এ এক গভীর ভালোবাসা যার জন্য নিজের সব কিছু দিয়ে দেওয়া যায়...

    উত্তরমুছুন
  5. খুব ভালো লাগলো এ এক নিঃস্বার্থ প্রেমের গল্প এ এক গভীর ভালোবাসা যার জন্য নিজের সব কিছু দিয়ে দেওয়া যায়...

    উত্তরমুছুন
  6. পুরো বিষয়টা পড়েই ডাউনলোডে চাপালাম

    উত্তরমুছুন